আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

পুরনো সেই দিনের কথা...!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-০৬ ২০:১৯:০২

শামসুল ইসলাম শামীম ::
‘স্বামী করে শরীর সাধন
প্রেমিক করে প্রেম সাধণা
প্রেম সাগরে পাইলে প্রেমিক
সেই সুজনের নাও ডুবেনা
শামীমের অন্ত:পুরে
কেবল রঙের মন ভজনা. . . .’

২০১২’র ডিসেম্বর; সন্ধ্যার পর কলকাতায় গঙাপাড়ে বসে আছি। মৃদুমন্দ ভেজাভেজা হাওয়া, মন ভিজিয়ে দিতে আর কিছুর প্রয়োজন আছে কী! আমার ডানে ফুটপাচেকের দূরত্বে বসে আছেন এক তরুণ। গঙাপাড়ের আধোআলোয় খেয়াল করলাম তরুণটির দিকে। কাধঅব্দি কোকড়ানো চুল, চোয়াল ভাঙা ছিপছিপে শরীর। প্রথম দেখায় ‘নস্যিবাবা’ ভেবেছিলাম, বার কয়েক লক্ষ্য করার পর ভুল ভাঙলো। মাথা নিচু করে খুব মন দিয়ে গুনগুন করছেন। বুঝলাম, কোন একটা কঠিন গানের সুর আয়ত্বে আনার চেষ্ঠা করছেন। আমার দিকে তাকালেন। ওই আধোছায়ায় বুঝতে পারলাম তরুণটির ঠোটে একফালি অমায়িক হাসি ঝুলে আছে। উঠে এসে আমার পাশে বসলেন; জিজ্ঞাসুনেত্রে ঘাড় ফেরালেন আমার দিকে-

: দাদা, কথা বলা যাবে?
: কথা বলবেন?
: সমস্যা?
: নাহ, অবাক হচ্ছি!
: কেনো দাদা?
: যে মানুষ কথা বলার মানুষ পায়না, তার কাছে বলতে উপযাচক হয়ে অনুমোতি চাইছেন, তাই।
তরুণটি কোন জবাব না দিয়ে মাথার অবিন্যাস্ত চুলগুলে পেছন দিকে এককতারে শামিল করার ব্যার্থ চেষ্টা করলেন। ফের আমার মুখের উপরে তার কেৌতুহলী চোখ-
: দাদা, একা?
: জ্বি, মানুষ মূলত: একাই!

তরুণটি খানিকটা হতচকিত হলেন। অকস্মাৎ এমন জবাবের জন্য হয়তো তৈরী ছিলেন না। সেকেন্ড চল্লিশেক সময় নিলেন। ফের চোখে চোখ রাখলেন-
: দাদা, কী করেন?
: ভবঘুরে!
: এটা কী কারো পরিচিতি হতে পারে দাদা?
: কেনো পারেনা?

তরুণটি কোন জবাব দিলেন না। নিজে থেকেই জানালাম, কলকাতা বেড়াতে এসেছি, ট্যুরিস্ট। শুরু হলো আলাপন। তরুণটির নাম দেবব্রত রায়। জানালেন, তিনি একজন শিক্ষার্থী, পড়েন একটি বেসরকারী কলেজে। এবারই অনার্স শেষ করে বেরুবেন। সরকারী চাকুরী করবেন না। ওতে নীতি-নৈতিকতা থাকেনা! বাবার ছোটখাটো ব্যবসা আছে, ওটাই দেখাশোনা করবেন। বড্ড গানপাগল মন, তাই গানকেই জীবনে জড়িয়ে রাখবেন। বসতভিটে গঙার আশেপাশেই। নিমন্ত্রণ দিলেন তার তার বাড়িতে এক টেবিলে খেতে। প্রায় দু’ঘন্টার গাল-গল্পের শেষ পর্যায়ে দু’টো বাউল গান শোনালেন। কন্ঠ ভালোই, তবে গানের কথাগুলোতে ভুলের আধিক্য। ভুলগুলো ধরিয়ে দিলাম না, পণ্ডিতি করতে মন সায় দিলোনা। বললাম-
: যার গান শোনালেন তাকে জানেন?
: হ্যা, শাহ আব্দুল করিম।
: আর কিছু?
: তিনি ঢাকার বাসিন্ধা!

আমি কিছু বললাম না। পরে মনে হলো ভুল শুধরে দেয়া উচিৎ ছিলো। ওই সময় কিন্তু মন সায় দেয়নি। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো আর শঠতা করতে পারিনা! যদিও অনেকেই পারে! জানতে চাইলাম-
: দ্বিজদাসের গান জানেন?
: মহাশয়ের নাম শুনেছি, গান জানিনা।
: শিখবেন, ভালো লাগবে।
আমার আর কথা বলতে ভালো লাগছেনা। আমি গঙার কাছে এসেছি, গঙা ফেলে এসব কথা এখন তেতো লাগছে। কিন্তু তরুণটির উঠার কোন হদিস পাচ্ছিনা। ভাবছি, নিজে থেকেই বিদায় নিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসবো। এই ভাবনার ফাকেই তরুণটি পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে আমার সামনে ধরলেন-
: একটু দেখবেন দাদা?
: কি?
: একটা গান লিখেছি, একটু যদি দেখতেন!
: আমি তো গান বুঝিনা
: ভগবানের কাছে প্রার্থণা, আমার ধারণা যেনো ভুল না হয়!
: কি ধারনা?
: আপনি আমার গানটি দেখেন!

মোবাইলের আলোয় গানটির উপর চোখ বোলাতে শুরু করলাম। বানানের শ্রাদ্ধ হয়েছে পুরো কাগজ জুড়ে, মন চাইলো জিজ্ঞেস করি কাঙালীভোজ কবে! করলাম না। দুই অন্তরার গান, মানে অসমাপ্ত। তরুণটির দিকে তাকালাম-
: বাকিটুকু?
: ওটুুকু মেলাতে পারছিনা, হেল্প করবেন দাদা?
আমার জবাবের তোয়াক্কা না করেই বুক পকেটে আধোউগড়ে থাকা কলমটি আমার দিকে বাড়ি দিলেন। শেষ অন্তরাটুক লিখে দিলাম। তরুণটির চোখ চকচক করছে। আমার ভালো লাগছে। গঙাকে নিজের গঙা বলে মনে হচ্ছে। খুব আপন লাগছে। তরুণটির হাত আমার হাত ধরে আছে। চোখে মুখে তৃপ্তি আর বিনয় গলোগলো করছে-
: দাদা, আমাকে একটি গান দিবেন?
: গান? কি গান?
: আপনার লিখা একটি গান!

আমি অপার বিষ্ময়ে তরুণটির দিকে তাকিয়ে আছি। তরুণটির চোখে মুখে আকুতি! আর কিছু বললাম না। কি ভেবে যে তার হাতের কাগজটি হাতে নিলাম আজো এই প্রশ্নের কুলকিনারা করতে পারিনি। মিনিট কয়েকের মধ্যে একটি যাচ্ছে তাই গান লিখে দিলাম। এই গানটিই হচ্ছে উপরের সেই গানের নামঅন্তরা।

দীর্ঘ বছর পর গত রাতে আমার ইমেলে তরুণটি জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে গানের অডিও রেকর্ড শেষ হয়েছে। পূজোর পর ভিডিও চিত্রায়ণ হবে। ওই সময়টায় যেনো আমি তার সাথে থাকি! সাথে পূজোর নিমন্ত্রণ। আমি অভিভুত হয়েছি, আপ্লুত হয়েছি। মেইলটি পড়ে আমার চোখের কোনটা ভেজাভেজা ঠাহর হলো। কেনো হলো জানিনা ! ওই তরুণটিকে আমার খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে, কেনো করছে!

লেখক: সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন