আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগ: একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১২-১৩ ১৪:১৩:০২

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল :: কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে দেশের উৎপাদনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে জনসাধারনের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং এতে আয়স্তর বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রারমানের উন্নয়ন ঘটে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে উৎপাদনের মাধ্যমে আয়স্তর বৃদ্ধি এবং ধনী-গরীবের বৈষম্যদূরীকরণ বুঝে থাকি। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কোন দেশ বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সিলেট বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। সিলেট অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এবং দেশীয় উদ্যোগতাগণ-প্রবাসীগনের উপযুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শিল্পায়নের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে।

সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, চুনাপাথর, কয়লা, পাথর, বালু উল্লেখযোগ্য। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এ অঞ্চলের শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরেই সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণ বাংলাদেশে বেশী পরিমান রেমিটেন্স পাঠায়। বর্তমানে ইংল্যান্ডে প্রায় ৫ লক্ষ বাংলাদেশী অবস্থান করছেন। এদের মাঝে প্রায় ৯০% সিলেট অঞ্চলের প্রবাসী। সিলেট বিভাগের প্রায় ১৬% পরিবার প্রবাসীগণের মাধ্যমে অর্থ পেয়ে থাকেন।
 
নিম্নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ এর জুন পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে বিদেশ থেকে আগত রেমিটেন্সের তথ্য তুলে ধরা হল:
মাসের নাম    ২০১৩ সাল  (কোটি টাকায়)    ২০১৪ সাল  (কোটি টাকায়)    ২০১৫ সাল  (কোটি টাকায়)    ২০১৬ সাল  (কোটি টাকায়)    ২০১৭ সাল  (কোটি টাকায়) (জুন মাস পর্যন্ত)
জানুয়ারী    ১০১১.২৯    ১০৭৩.৮১    ১০১০.৯১    ৯৪০.৫৬    ৯৪০.৯৬
ফেব্রুয়ারী    ৯৪৭.৭৩    ১০৪৮.৩৩    ৯৪০.৭৯    ৯৪৫.২৫    ৭৬৮.৫৭
মার্চ    ৮৪৬.১৭    ১০৭১.৭৯    ১১১৩.১৩    ১০৬৪.৩০    ৮০৭.৯৮
এপ্রিল    ৮৯৬.৫৫    ১০৭২.০৭    ১০০৫.৮৬    ৯৬৮.৯৫    ৮৬১.০৫
মে     ৮৪০.৩৮    ৯৩৭.৯০    ১০৪৭.২০    ১০৪৫.১০    ৯৪৯.১৬
জুন     ১৩৫৬.১৪    ১১৫৬.৩৩    ১১৯২.১৬    ১২৪২.৮০    ১৩০৫.১৩
জুলাই    ১০৪৮.১৩    ১২১৪.৮৮    ১১০৯.৭৯    ৭৩৬.০৩    -
আগষ্ট    ৮৪৩.৮৪    ৯৯৩.২০    ৯৮৭.৫৬    ৯৮৮.৪৭    -
সেপ্টেম্বর     ৯৪৮.৫২    ১১১৪.৩৮    ১৩১২.৩৯    ৯৮৪.৯৮    -
অক্টোবর    ১০৯৫.৫৮    ৮৪৮.৩৬    ৯৭২.৪২    ৮১৮.৭৫    -
নভেম্বর    ৭৮৪.১০    ৯০১.৭৯    ১১৫৯.৮    ৭২৯.৭৬    -
ডিসেম্বর    ১০৫৭.৯১    ১১৯৩.৩৯    ১০৪৭.৬    ৮৫৯.১৫    -
মোট    ১১৬৭৬.৩৪    ১২৬৫৬.২৩    ১২৮৯৯.৫৫    ১১৩২৩.০০    ৫৬৩২.৮৫
 
এসব অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে ও ভোগ বিলাসে এবং এর ফলে দ্রব্যমূল্যে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিলেট শহরের বন্দর বাজার এলাকার মাছের উচ্চ মূল্যের একটি অন্যতম কারন হল প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। এছাড়াও জমিক্রয়ে, বিলাস-বহুল বাড়ী নির্মাণে, ফ্ল্যাট ক্রয়ে প্রবাসীগণ অর্থ ব্যয় করে থাকেন। বিভিন্ন পবিত্রস্থান এবং পবিত্র প্রতিষ্ঠানেও প্রবাসীগণ কর্তৃক অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। দোকান নির্মাণে, কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠায় এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিতরনের মাধ্যমে প্রবাসীগণ কর্তৃক প্রেরিত অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সিলেট শহরের বিলাস-বহুল হোটেল নির্মাণে এবং বিভিন্ন শপিংমল তৈরীতে ইতিমধ্যে প্রবাসীগণ কর্তৃক প্রেরিত অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। উৎপাদনমুখি খাতে এসব অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থিত বারাকা পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানী, সিলেট শহরের রোজভিউ হোটেল, হবিগঞ্জের বাহুবলে অবস্থিত দি প্যালেস রিসোর্ট, সিলেটের খাদিমপাড়ায় অবস্থিত এক্সেলসিয়র হোটেল এন্ড রিসোর্ট-এ প্রবাসীগণের বিনিয়োগ রয়েছে। 
২০১৬ সালের বিভিন্ন মাসে বাংলাদেশে আগত রেমিটেন্সের পরিমান তুলে ধরা হলো:
মাসের নাম    কোটি টাকা
জানুয়ারী    ৯,০৩২
ফেব্রæয়ারী    ৮,৯২৩
মার্চ    ১০,০৮১
এপ্রিল    ৯,৩৩৯
মে     ৯,৫২২
জুন     ১১,৪৯২
জুলাই    ৭,৮৮৩
আগষ্ট    ৯,২৮০
সেপ্টেম্বর     ৮,২৮৪
অক্টোবর    ৭,৯২৬
নভেম্বর    ৭,৪৭২
ডিসেম্বর    ৭,৫৫৫
মোট     ১,০৬,৭৮৯

২০১৬ সালে বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিটেন্স এসেছে ১,০৬,৭৮৯ কোটি টাকা এবং সিলেট অঞ্চলে রেমিটেন্সের পরিমান ছিলো ১১,৩২৩ কোটি টাকা দেশের মোট রেমিটেন্সের ২০১৬ সালে সিলেট অঞ্চলের অংশ ছিল প্রায় ১০.৬%।
 
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন অর্থ বছরে বাংলাদেশে আগত মোট রেমিটেন্সের তথ্য নিম্নে দেয়া হলো:
অর্থ বছর    দেশে প্রাপ্ত মোট রেমিটেন্স  (কোটি টাকায়)
২০১২-২০১৩    ১,০১,৮৮২
২০১৩-২০১৪    ১,১০,৫৪৫
২০১৪-২০১৫    ১,১৮,৯৯৩
২০১৫-২০১৬    ১,১৬,৮৫৭
২০১৬-২০১৭    ১,০১,০৯৯
সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যাংকে রক্ষিত আমানত এ অঞ্চলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম (ঋণ/বিনিয়োগ) ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিলেট অঞ্চলের ব্যাংক সমূহে বিভিন্ন বৎসরে প্রাপ্ত ব্যাংক আমানত এবং ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ব ঋণের পরিমাণ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
বছর     ব্যাংক আমানত (উবঢ়ড়ংরঃ)  (কোটি টাকায়)    ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ব ঋণ (খড়ধহ ধহফ অফাধহপবং) (কোটি টাকায়)     ঋণ-আমানতের অনুপাত (উবঢ়ড়ংরঃ-খবহফরহম জধঃরড়) 
২০১২    ২৩,০৩৪.৯৮    ৭,৪৪৯.৮৪    ০.৩২৩৪
২০১৩    ২৮,০৪০.৮২    ৬,৭৫১.৯৯    ০.২৪০৮
২০১৪    ২৯,২৮৬.৯৪    ৬,৮১৩.৪৬    ০.২৩২৬
২০১৫    ৩৪,১৬৪.৩০    ৭,৭৫৩.১৬    ০.২২৬৯
২০১৬    ৩৭,৬০৬.০১    ৮,৯৮৮.৫৯    ০.২৩৯০
২০১৭ (জুন পর্যন্ত)    ৩৬,৬০৯.৭৭    ৯,০৩৯.০২    ০.২৪৬৯

একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঋণ-আমানতের অনুপাত ০.৬৯, ঢাকা অঞ্চলে ঋণ-আমানতের অনুপাত ০.৮৯, খুলনা অঞ্চলে ঋণ-আমানতের অনুপাত ০.৯০, রাজশাহী অঞ্চলে ঋণ-আমানতের অনুপাত ০.৭৯ এবং বরিশাল অঞ্চলে ঋণ-আমানতের অনুপাত ০.৫৮। এখান থেকে প্রতিয়মান হয় যে, সিলেট বিভাগের প্রাপ্ত ব্যাংক আমানতের ব্যবহার দেশের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে অনেক কম। বাংলাদেশে ব্যাংক কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সিলেট অঞ্চলে ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত শিল্পখাতে ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬%।

বি.এম.ই.টি-এর তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে জেলা ভিত্তিক বিদেশগমনকারীদের (চাকুরীর প্রয়োজনে) সংখ্যা তুলে ধরা হলো:
জেলা    বিদেশগমনকারীর সংখ্যা (চাকুরীর প্রয়োজনে)
কুমিল্লা    ৮৬,৩৫২ জন
চট্টগ্রাম    ৪৫,৭৮০ জন
ঢাকা    ৩১,৫০৮ জন
নোয়াখালী    ২৮,৩৪২ জন
সিলেট    ১৮,৫১৭ জন
বরিশাল    ১০,৬৫০ জন
যশোর    ৬,৮৪৮ জন
সুনামগঞ্জ    ৪,৩৫১ জন
খুলনা    ৩,৬০৪ জন
হবিগঞ্জ    ১৬,২৫১ জন
মৌলভীবাজার    ১৪,৪২৯ জন

সর্বমোট সিলেট বিভাগ থেকে চাকুরীর প্রয়োজনে বিদেশ গমনকারীর সংখ্যা- ৫৩,৫৮৪ জন।
২০০৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চাকুরীর প্রয়োজনে জেলা ভিত্তিক বিদেশগমনকারীর সংখ্যা নিম্নে দেয়া হলো:
জেলা    বিদেশগমনকারীর সংখ্যা (চাকুরীর প্রয়োজনে)
কুমিল্লা    ৭,০৫,৪৯০ জন 
চট্টগ্রাম    ৫,৮৭,৪৮৯ জন
ঢাকা    ২,৮৫,২৪২ জন
সিলেট    ১,৫৩,৪২২ জন
ময়মনসিংহ    ১,৩৮,১৯৬ জন
বরিশাল    ৯০,০৪০ জন
পাবনা     ৭২,৪৫২ জন
সুনামগঞ্জ    ৪৪,৪৩৬ জন
খুলনা    ২৮,২৭১ জন
মৌলভীবাজার    ১,৩০,১৭৬ জন
হবিগঞ্জ    ১,০৯,৯৭৮ জন
২০০৫-২০১৬ পর্যন্ত চাকুরীর প্রয়োজনে সিলেট অঞ্চল থেকে বিদেশগমন করেছেন- ৪,৩৮,০১২ জন।
 
বি.এম.ই.টি এর তথ্য অনুসারে এবং তথ্য বিশ্লেষনের মাধ্যমে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশী এবং সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণের তালিকা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
বিভিন্ন দেশ     বাংলাদেশের প্রবাসীর সংখ্যা (প্রায়)    বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীর সংখ্যা (আনুমানিক)   
% (প্রায়)
সৌদি আরব    ১০,২০,০০০ জন     ২,৩৫,০০০ জন    ২৩.০৪%
ইংল্যান্ড     ৪,৮০,০০০ জন    ৪,৩২,০০০ জন     ৯০%
কুয়েত     ১,৮০,০০০ জন     ৪৩,০০০ জন     ২৩.৯%
ওমান     ১,৭০,০০০ জন     ৪২,০০০ জন     ২৪.৭%
ইতালি     ১,৩৫,০০০ জন     ২২,০০০ জন      ১৬.২৯%
আমেরিকা     ১,১০,০০০ জন     ১১,০০০ জন     ১০%
সংযুক্ত আরব আমিরাত     ৭,০০,০০০ জন     ১,২০,০০০ জন    ১৭.১৪%
মালয়েশিয়া    ৬,০০,০০০ জন     ৫০,০০০ জন     ৮.৩৩%
কাতার     ১,৪০,০০০ জন     ৪০,০০০ জন     ২৮.৫৭%

বি.এম.ই.টি এর তথ্য অনুযায়ী এবং বি.এম.ই.টি বাংলাদেশে ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্ট এসোসিয়েশন সিলেট জোনের দেয়া তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত দেশের মোট রেমিটেন্স এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণের মাধ্যমে প্রাপ্ত রেমিটেন্সের তথ্য নিম্নে তুলে ধরা হলো:
বিভিন্ন দেশ     দেশে প্রাপ্ত মোট রেমিটেন্স  (কোটি টাকা)     সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণের মাধ্যমে প্রেরিত রেমিটেন্স (আনুমানিক)
(কোটি টাকা)   
% (প্রায়)
সৌদি আরব    ১৭,৬৮৪.৩২     ২,০৫০    ১১.৫৯%
সংযুক্ত আরব আমিরাত    ১৬,৩২৯.৬১    ২,১০০    ১২.৮৬%
আমেরিকা    ১৩,১৭৩.১২    ৫০০    ৩.৭৯%
মালোয়শিয়া    ৮,৬০৩.৪    ৪৫০    ৫.২৫%
কুয়েত    ৮,০৫৭.৪    ৯০০    ১১.১৭%
ওমান    ৭,০০২    ১০০০    ১৪.২৮%
ইংল্যান্ড     ৬,৩০৩    ৪,১০০    ৬৫.০৫%
কাতার     ৪,৪৯০    ৬৫০    ১৪.৪৭%
ইতালি    ৩৯৮৪    ২০০    ৫.০২%

ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও প্রচুর পরিমান প্রবাসীগণ কর্তৃক প্রেরিত অর্থ সিলেট অঞ্চলে এসে থাকে।
প্রবাসীগণ কর্তৃক প্রেরিত অর্থের বিভিন্নমুখী প্রভাব:

১.সামাজিক-পারিবারিক সমস্যা এবং অর্থের অপব্যবহার:
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সম্পদের সঠিক ও সুষ্ঠু ব্যবহার এবং উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ। সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার হয় না। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থে কিশোর ও যুবক শ্রেনীর অনেকের মাঝে জীবনযাত্রার অসামাঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এতে পারিবারিক সমস্যা জনিত অস্থিরতা দেখা যায়। এ অবস্থায় প্রবাসী আত্মীয়স্বজন সমস্যায় জর্জরিত কিশোর অথবা যুবককে ব্যবসার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেকেই সফল ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার চেষ্টা না করে অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার করে থাকেন। কেউ কেউ বিয়ের মাধ্যমে বিদেশ যাবার চেষ্টা করেন।
 
২.অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চ মজুরীর হার:
সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হয়ে থাকে। রেমিটেন্সের প্রভাবে সিলেটে কর্মজীবী মানুষের মজুরীর হার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা বেশী। বৈদেশিক অর্থ প্রভাবিত করে জীবনযাত্রারমান, সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে। 

৩.প্রবাসীগণের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি সংক্রান্ত সমস্যা:
দেশে প্রবাসীগণের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির জন্য উপযুক্ত বিশ্বস্থ ব্যক্তির অভাবও একটি সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীরা বিশ্বস্থ লোকের অভাবে প্রতারিত হন। দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কারণে অনেক প্রবাসী দেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অথচ প্রবাসীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন প্রবাসীদের অর্থের সঠিক, সুষ্ঠু ও উৎপাদনসমূখী বিনিয়োগ। দেশের স্বার্থেই প্রবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
   
৪.বিশ্বস্থ ব্যক্তির অভাব এবং  ব্যবসায়ীক ঝুঁকি গ্রহণে অনীহা:
সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীদের মাঝে যারা দীর্ঘ দিন যাবৎ বিদেশ অবস্থান করছেন, তাদের সাথে দেশের সম্পর্ক হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বস্ত ব্যক্তির অভাবে প্রবাসীরা প্রায়ই ব্যবসায়ীক ঝুঁকি নিতে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন।
 
৫.অলসতা, কর্মবিমুখতা এবং ডিগ্রী অর্জনে অনীহা:
উৎপাদনমুখী বিনিয়োগের সুযোগ কম থাকায় এ অঞ্চলে অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থের বিনিয়োগ বেশী। বিনা পরিশ্রমে অর্থ প্রাপ্তির ফলে অনেক ক্ষেত্রে কর্মবিমুখতা এবং অলসতা দেখা যায়। বিদেশগমন অনেকের লক্ষ্য হবার ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ এবং ডিগ্রী অর্জনে অনীহা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। 
 
৬.শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যয়:
সিলেট শহরের চারটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রদের একটি বিরাট অংশ বিদেশে অবস্থানরত অভিভাবক এবং আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে পাঠানো অর্থ দিয়ে শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয় মিটিয়ে থাকেন।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি প্রবাসী বিনিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনের জন্য সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্ভব।

সিলেট অঞ্চলে বিনেয়োগের সুবিধা সমূহ:
সিলেট অঞ্চলে রয়েছে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ। এ অঞ্চলে স্থানীয় জনগণের মাঝে রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও ঐক্য। এছাড়াও এখানে জনগণের মাঝে রয়েছে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে সহায়তা প্রদানের মানসিকতা। এ অঞ্চলে চাঁদাবাজি নেই অথবা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক কম। এ অঞ্চলে রয়েছে পুঁজি, জমি এবং কাঁচামালের (চুনাপাথর, পাথর, বালু ইত্যাদি) পর্যাপ্ততা। গ্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- তেল, বনাঞ্চল, কয়লা ইত্যাদির পর্যাপ্ততা সিলেট অঞ্চলে রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে স্থলবন্দরের সুবিধা এবং দুষণমুক্ত পরিবেশ। সিলেট অঞ্চলে বিদ্যুতের উৎপাদন এবং সরবরাহ ভালো।
  
সিলেট অঞ্চলে সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাত সমূহ:
১.আগর-আতর শিল্প (Agar-Atar Industry)
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আগর-আতর শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক আগর গাছের বাগান থাকার কারণে আগর-আতর শিল্প ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে। কাঁচামালের সহজলভ্যতার ফলে তুলনামূলক কম খরচে আগর-আতর উৎপাদন করা বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে সম্ভব হচ্ছে। বড়লেখা উপজেলার সুজানগরে আগর-আতর উৎপন্ন হয়ে থাকে। প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মিটার আগর কাঠ প্রতি বছর উৎপাদিত হয়। এরোমেটিক আগর উড প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি প্রতি বছর উৎপাদন করা হয়। পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগর কারখানায় আগর-আতর উৎপাদন করা হয়। আগর-উড ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে আগর-শ্রমিকরা সুগন্ধী কাঠ প্রস্তুত করেন। বর্তমানে বড়লেখার সুজানগরে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০টি আগর কারখানা চালু রয়েছে। এদের মাঝে সুজানগরের সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ, আল-মুহিত আগর-আতর  ফ্যাক্টরী, মা আগর-আতর ফ্যাক্টরী, সাজ-আগর আতর এন্টারপ্রাইজ অন্যতম। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে আগর-আতর শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার। প্রায় ২৫টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত আতর ক্রয় করে থাকে। এর মাঝে সংযুক্ত আরব-আমিরাতের রোজ ভ্যালী এবং আল হাসেমী অন্যতম। আগর গাছ ইন্দোনেশিয়া, মালোয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্পোডিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে উৎপন্ন হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলের উৎপাদিত আতর সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে রপ্তানী হয়ে থাকে। উৎপাদিত আগর-আতর রপ্তানীর পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। আগর-আতর রপ্তানীরসাথে জড়িত সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের কর্মচারীর সংখ্যা ৫০ জন। সুজানগরের সাজ আগর-আতর ইন্ডাষ্ট্রী এর কর্মচারীর সংখ্যা ৩০ জন এবং বে অফ বেঙ্গল এর কর্মচারীর সংখ্যা ৫০ জন। আগর-আতরের কাঁচামাল আগর গাছ সিলেট অঞ্চলে উৎপন্ন হবার ফলে আগর কারখানাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানী করতে হয় না। আগর-আতর শিল্পের অন্যতম সমস্যা হলো অতিরিক্ত গ্যাস বিল। আগর-আতর শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা মনে করেন গ্যাস বিল বাণিজ্যিক হারের স্থলে শিল্পহারে করা দরকার এবং নতুন কারখানায় গ্যাস সংযোগ প্রদান করা প্রয়োজন। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিক ল্যাব স্থাপন করে আতরের গুণগত মান এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা দরকার। বনবিভাগের আগর-গাছ প্রকৃত ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিলামে বিক্রি করা এ শিল্প বিকাশের জন্য প্রয়োজন। বনবিভাগের অনুমতির জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস করা প্রয়োজন। ২০১৩ সালে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এখনও পর্যন্ত শিল্পের সুবিধা তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।
 
২.সিরামিক শিল্প (Ceramic Industry)
সিলেট অঞ্চলে সিরামিক শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। সিরামিক পণ্যের বিভিন্ন ধরনে কাঁচামাল যেমন বিভিন্ন ধরনের কাদামাটি, সোডা, সিলিকা প্রভৃতি সিলেট অঞ্চলে পাওয়া যায় এবং চীন, ভারত ও মালেয়শিয়া থেকে আমদানী করা হয়। সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সিরামিক নির্মিত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে সিলেট জেলায় স্থাপিত খাদিন সিরামিকস লিমিটেড অন্যতম। খাদিম সিরামিকস লিমিটেডের পণ্য ১৯৯৫ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে রপ্তানী হচ্ছে। গত দুই বছরে ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে খাদিম সিরামিকস লিমিটেড ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। সিলেট অঞ্চলের অন্যান্য সিরামিক নির্মিত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইউরো-বাংলা সিরামিকস, ফু-ওয়াং সিরামিকস, র‌্যাক সিরামিকস, হার্ড ল্যান্ড সিরামিকস, হবিগঞ্জের স্টার সিরামিকস ইত্যাদি। গ্রেড ওয়াল নামক অন্য একটি সিরামিক নির্মিত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন ধরনের টাইলস, যেমন- ওয়াল টাইলস, রুফ টাইলস, ফ্লোর টাইলস, ওয়াল ডেকোরেটিভ টাইলস উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়াও বাথরুম ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার ইত্যাদি উৎপাদন করা হচ্ছে। গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ফলে হবিগঞ্জে আরও সিরামিক নির্মিত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলে সিরামিক নির্মিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে তবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অঞ্চলে সিরামিক নির্মিত পণ্যের আরও উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সিলেট অঞ্চলের অধিবাসীগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে সিরামিক নির্মিত সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। সিলেট অঞ্চলে কাঁচনির্মিত তৈজসপত্র উৎপাদন করা সম্ভব। সিলেট অঞ্চলে সিরামিক শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে গ্যাস সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
জল ও স্থল বন্দর সিলেট ও সুনামগঞ্জে ব্যবহার করা সম্ভব হলে এ শিল্পে আরও উপকৃত হতো। দক্ষ জনবলের অভাব এ অঞ্চলের সিরামিক শিল্পের একটি সমস্যা। এ জন্য রাজধানী ঢাকা থেকে লোকবল ভাড়া করে আনা হয়। কাঁচামালের ঘাটতিও এ শিল্পের একটি সমস্যা। বিভিন্ন জটিলতার কারণে উৎপাদিত পণ্য সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করতে অধিক সময় লেগে যায়। কোন স্থানীয় বন্দর না থাকায় চট্টগ্রাম অথবা নারায়নগঞ্জ থেকে কাঁচামাল আনয়ন করতে হয়।
তামাবিল বন্দর ব্যবহার করে ভারতের সেভেন সিস্টার এ সিলেট অঞ্চলের সিরামিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে উৎপাদিত সিরামিক সামগ্রী রপ্তানী করার সুযোগ রয়েছে। সিরামিক কারখানার ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাংশে আমদানীর জন্য কর কমানো প্রয়োজন। সিরামিক সামগ্রী উৎপাদনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষন কর্মসূচীর আওতায় আনা প্রয়োজন।

৩.রাবার শিল্প (Rubber Industry):
বর্তমান যুগে রাবার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পণ্য। বিশ্বে প্রাকৃতিক রাবার থেকে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য ও অত্যাবশ্যকীয় প্রায় ৪৬ হাজার পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলের পাহাড়, টিলা ও উচ্চভূমিতে রাবার উৎপাদন শুরু হয়েছে। বন বিভাগ ১৯৬০ সালে ৭১০ একরের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাবার চাষের সূচনা করে। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী বেসরকারী খাতে রাবার চাষ কর্মসূচী গ্রহণ করে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ২৫ একরের ১৩০২ টি প্লটে মোট ৩২,৫৫০ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তি/ফার্মকে রাবার উৎপাদনের জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয়। বাংলাদেশে কাঁচা রাবার উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছোট থেকে মাঝারি পর্যায়ের অনেকগুলো রাবার শিল্প গড়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে রাবার শিল্প কারখানার সংখ্যা ৪০০ এর বেশী। এ সকল শিল্প কারখানায় হাওয়াই চপ্পল, টায়ার, টিউব, রাবার শিট, বেল্ট, গাম বুট, বেলুন ও নানা প্রকার রাবারজাত দ্রব্যাদি তৈরী হচ্ছে।
একটি বিশেষ সমীক্ষা মোতাবেক ২০২০ সাল নাগাদ দেশে ১,০০,০০০ টন কাঁচা রাকারের প্রয়োজন হবে এর জন্য ১,৮২,০০০ একর জমি রাবার চাষের আওতায় আনা প্রয়োজন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ৬,২২৬ হেক্টর জমিতে রাবার উৎপাতন করা হচ্ছে। সিলেট জেলার মালনিছড়া, লাক্কাতুরা, মনিপুর, মোমিনছড়া ইত্যাদি চা বাগানে রাবার চাষ হচ্ছে। সরকারী উদ্যোগে মৌলভীবাজার জেলার ভাটেরা রাবার বাগানে রাবার উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়াও কুলাউরার হিংগাদিয়া রাবার বাগান এবং বরমচাল রাবার বাগানে রাবার উৎপাদন হচ্ছে। হবিগঞ্জের রশিদপুরে এবং সিলেট জেলার খান চা বাগানে রাবার উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়াও আরও কয়েকটি চা বাগানে রাবার চাষ করা হচ্ছে।
সিলেট অঞ্চলে সর্বমোট রাবার উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৩৬,৭১,০০০ কেজি। বিভিন্ন ধরনের রাবার জাত পণ্য উৎপাদনে সিলেট অঞ্চলের রাবার ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশেও সিলেট অঞ্চলের রাবার রপ্তানী হচ্ছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে রাবার উৎপাদনের এবং রাবারজাত পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবাসী বিনিয়োগের একটি সম্ভাব্য খাত হতে পারে রাবার শিল্প। সিলেট অঞ্চলের রাবার উৎপাদন বৃদ্ধিতে উঁচু টিলাগুলোকে রাবার চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। খাদিমনগর এবং হাবিবনগরের টিলাগুলোকে রাবার উৎপাদনের আওতায় আনা যেতে পারে। সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন রাবারজাত পণ্য যেমন- সাইকেল তৈরির টায়ার, টিউব, গামবুট, ইত্যাদি তৈরীর কারখানা হতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ কম হবে।
বর্তমানে প্রতি কেজি রাবারের দাম হ্রাস পাওয়ায় এবং বেশি ভ্যাট প্রদানের ফলে রাবার চাষের অর্জিত মুনাফা হ্রাস পেয়েছে। সিলেট অঞ্চলের রাবার শিল্পের বিকাশে চা বাগানসমূহের অব্যবহৃত জমি রাবার চাষের আওতায় আনা প্রয়োজন।

৪.কৃষিজাত শিল্প (Agro Based Industry):
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে কৃষিজাত শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ধান এবং সব্জি উৎপন্ন হয়। এছাড়াও তেজপাতা, লেবু, কলা, আনারস, কমলা কাঠাল ইত্যাদি এ অঞ্চলে উৎপন্ন হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলের লেবু বিদেশে রপ্তানী হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলে আচার, জেলি, সস, পাটজাত পণ্য উৎপাদন এবং বিক্রয়ের সুযোগ রয়েছে। সিলেট শহরের বালুচরে অবস্থিত নিকোবিনা কোম্পানী বিভিন্ন ধরনে আচার তৈরি করে থাকে। নিকোবিনা কোম্পানীর আচার ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ আমেরিকাতে রপ্তানী করা হয়।  চাষী ফুড প্রোডাক্টস সিলেট শহরের রায়নগরে অবস্থিত এবং বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি করে। জনপ্রিয় এন্টারপ্রাইজ সরিষার তেল প্রস্তুত ও বিক্রয় করে। প্রাণ কোম্পানীর জুস হবিগঞ্জের মাধবপুরে তৈরি করা হয়।
সিলেট শহরের বালুচরে একটি ফ্যাক্টরীতে মুড়ি, চিড়া, ইত্যাদি প্রস্তুত করা হয় এবং থাইল্যান্ড এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে রপ্তানী করা হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলের সুগন্ধি চাল, বিরনী চাল, এলাচ বিদেশে রপ্তানী করা সম্ভব। গুটাটিকরে অবস্থিত বিসিক শিল্প এলাকায় ফিজা, স্বাদ, রসমেলা, মঞ্জিল গ্রæপ নামক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, দই, রসমালাই, কেক, বিস্কুট, চানাচুর প্রভৃতি প্রস্তুত করা হয় এবং বিদেশেও রপ্তানী হয়ে থাকে। খাদিমে অবস্থিত বিসিক শিল্প এলাকায় বনফুল সুইটস লিমিটেড এবং মধুবন সুইটস লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে মধু চাষ বৃদ্ধি এবং আনারস প্ল্যান্ট এর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
সিলেট অঞ্চলে তোহফা এগ্রো প্রসেস নামক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের আচার ও তেজপাতা ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকায় রপ্তানী করে থাকে। তোহফা নামক প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাক্টরী বর্তমানে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি আম এবং লিচুর জুস তৈরীর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শ্রীমঙ্গলের লেবু, আনারস ব্যবহার করে জুস তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের বেকারী সিলেট অঞ্চলে রয়েছে। শ্রীমঙ্গলে ইস্পাহানী ফুড প্রোডাক্সট ভুট্টা থেকে স্টার্চ তৈরী করে থাকে। হবিগঞ্জ এলাকায় টমেটো এর সস তৈরী হয়। হবিগঞ্জে ফুড প্রসেসিং প্ল্যান্ট রয়েছে। দেশীয় উদ্যোক্তাগণ এবং প্রবাসীগণের বিনিয়োগের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের কৃষিজাত শিল্প বিকশিত হতে পারে। ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি সংক্রান্ত সমস্যা এবং উচ্চ ঋণের সুদ সিলেট অঞ্চলের কৃষিজাত শিল্পের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়।

৫.পর্যটন শিল্প (Tourism Industry):
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় অঞ্চল। এখানকার পাহাড়, চা বাগান, হাওড়, ঝর্ণা ইত্যাদি পর্যটক আকর্ষণ করতে সক্ষম। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের আরো উন্নয়ন সম্ভব এবং এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এ অঞ্চলে বেশ কিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। এসব স্থান খুঁজে বের করে যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন। এ অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ নেয়া হলে স্বল্প বিনিয়োগে প্রচুর পরিমাণ মুনাফা অর্জনের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে পারে সিলেট অঞ্চলের পর্যটন শিল্প।
সিলেট অঞ্চলের ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী এ অঞ্চলের পর্যটন সেক্টরে বিনিয়োগ করা যায় তবে মুনাফা অর্জনের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া প্রবাসীদের অর্থ বিনিয়োগের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে পর্যটন শিল্পকে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এতে প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের সম্পর্কের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সাথে দেশের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে। এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প বিকাশে বৈদেশিক বিনিয়োগ কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের টুরিস্ট স্পটগুলোর মধ্যে জাফলং, মাধবকুন্ড, লাউয়াছড়া, লালাখাল, শ্রীমঙ্গল, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, ভোলাগঞ্জ, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও খাদিম রেইন ফরেস্ট, হামহাম জলপ্রপাত, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওড়, মাধবপুর লেক প্রভৃতি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় টুরিস্ট স্পট। এসব স্থানকে টার্গেট করে সিলেট তথা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। সিলেটে চিড়িয়াখানা ও শিশু পার্ক তৈরি হলে পর্যটন শিল্পে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপত্তার অভাব, স্পটগুলিতে আবাসনের স্বল্পতা, পার্কিং এর অভাব, প্রচারের অভাব, প্যাকেজ ট্যুরের অভাব, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, স্পটসংক্রান্ত তথ্যকেন্দ্রের অভাব, অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, সুষ্ঠু নীতিমালা ও পরিকল্পনার অভাব, বেসরকারী উদ্যোগে বিনিয়োগের অনীহা প্রভৃতি সমস্যা সিলেট অঞ্চলে পর্যটন শিল্প বিকাশের অন্তরায়। 
পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগকারীগণকে উৎসাহ প্রদান প্রয়োজন। টাঙ্গুয়ার হাওড় এলাকায় বেসরকারী উদ্যোগে এবং প্রবাসী বিনিয়োগ দরকার। এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প উন্নয়নে স্পটগুলোতে কৃত্রিম বিনোদনের ব্যবস্থা, পর্যটন পুলিশের ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পর্যটন বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, সরকারী-বেসরকারী যৌথ উদ্যোত, পর্যটকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা, দক্ষ জনবলের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা, আবাসন বৃদ্ধি, স্পটগুলোতে মেডিকেল সেন্টার স্থাপন, প্যাকেজ ট্যুর চালু প্রভৃতি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। পর্যটন শিল্প বিকাশে বাসস্থান, খাদ্য ও পানীয়, সুস্থ বিনোদন, যোগাযোগ ও নিরাপত্তা প্রয়োজন। স্পটগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন করা দরকার। এ শিল্প বিকাশে ঢাকা-সিলেট চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা প্রয়োজন। পর্যটন স্পটগুলোকে আরো সুন্দরভাবে সাজানো প্রয়োজন। সিলেট শহরের টিলাগড় ইকোপার্কটিকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা প্রয়োজন। পযটন শিল্প বিকাশে শব্দদূষণ হ্রাস করা একান্ত প্রয়োজন। সিলেট শহরের সৌন্দর্য বিকাশে সিলেটের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে অবৈধ গাড়ীর স্ট্যান্ড বন্ধ করা দরকার। বিশ্বে বিভিন্ন দেশের পর্যটনের আইডিয়া আমরা কাজে লাগাতে পারি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পর্যটন শিল্প বিকশিত হলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।

৬.তথ্য-প্রযুক্তি খাত (IT Sector):
সিলেট অঞ্চলে তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টরের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগের খাত হতে পারে আই.টি সেক্টর। সিলেট শহরে কম্পিউটার এবং এর বিভিন্ন অংশ আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নয়াসড়কে অবস্থিত স্মার্ট টেকনোলজি বাংলাদেশ লিমিটেড, পূর্ব জিন্দাবাজারে অবস্থিত গেøাবাল ব্রান্ড প্রাইভেট লিমিটেড এবং চৌহাট্টা আর.এন টাওয়ারে অবস্থিত ফ্লোরা লিমিটেড অন্যতম। সিলেট শহরে কম্পিউটার এবং এর বিভিন্ন অংশ বিক্রয়কারী প্রায় ১২০টি দোকান রয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। এসব দোকানগুলোর অবস্থান প্ল্যানেট আরাফে, কানিজ প্লাজায়, কাজী ম্যানশনে, গ্যালারিয়া শপিং কমপ্লেক্সে এবং বন্দরবাজারের করিমুল্লাহ মার্কেটে। দোকানগুলোর মাঝে কম্পিউটার গ্যালারী, জিনিয়াস টেকনোলজি, আই.টি গেইট অন্যতম। পূর্ব জিন্দাবাজারের আজগর স্কয়ারে অবস্থিত কোবা কম্পিউটার্স গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং প্রিন্টিং- এর কাজ করে থাকে। সিলেট শহরে প্রায় ২৫টি সফটওয়্যার প্রোডিউসিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মাঝে আখালিয়ায় অবস্থিত টেকনেক্সট, আখালিয়ার সুরমা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ইনফ্যানসি আই.টি, আম্বরখানায় অবস্থিত আউথল্যাব অন্যতম। সিলেট শহরের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও ৪টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে প্রায় ৪৫০ জন শিক্ষার্থী কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে গ্রাজুয়েট হচ্ছেন। এদের প্রায় ৮০% সিলেট অঞ্চলের অধিবাসী। এসব শিক্ষিত জনবল কাজে লাগিয়ে সিলেট অঞ্চলে আই.টি সেক্টরের উন্নয়ন সম্ভব। সিলেটের আই.টি খাতের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার কোম্পানীগঞ্জে একটি হাইটেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সিলেটের অনেকে আই.টি ফার্ম আউটসোর্সিং এবং ফ্রিল্যানসিং এর সাথে জড়িত।
সিলেট শহরে মেডিলাইফ সলিউশন্স (www.medilifesolutions.com)  নামক একটি আইটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয় জল্লারপাড় এলাকার লিয়াকত ভবনে এবং প্রধান কার্যালয় ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত। মূলত সিলেট অঞ্চলের কয়েকজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কামাল আহমেদ ফার্মটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মোবাইল অ্যাপ্স এর মাধ্যমে মেডিকেল সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে থাকে। মেডিকেল সংক্রান্ত আইটি ফার্ম মেডিলাইফ সলিউশন মোবাইল অ্যাপ্স এর মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সিস্টেম তৈরী করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মোবাইলে প্রেসক্রিপশন পাঠানো, বিভিন্ন ধরণের ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ, রোগীদের তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে সেগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। আইটি প্রতিষ্ঠানটি মেডিকেল সংক্রান্ত অ্যাপ্স ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী সফ্টওয়্যার প্রস্তুত করতে সক্ষম। মূলত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা প্রকৌশলীগণ প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত রয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণায় (Health Research) এ ব্যবহৃত হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটিকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রবাসী বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মৌলভীবাজারে কম্পিউটার এবং এর বিভিন্ন অংশ বিক্রয়কারী প্রায় ১০টি দোকান রয়েছে। এদের মধ্যে শ্রীমঙ্গল রোডে অবস্থিত ফাস্ট ট্র্যাক এবং চৌমোহনা কোর্ট রোডে অবস্থিত আই.টি সলিউশন অন্যতম। হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে বেশ কয়েকটি কম্পিউটার বিক্রয়কারী দোকান রয়েছে। সিলেট অঞ্চলের যুবক শ্রেণীর ফ্রিল্যান্সিং অথবা আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। কম্পিউটার এবং এর বিভিন্ন অংশ বিক্রয়কারী দোকান সমূহ ওয়ারেন্টি এবং সার্ভিস প্রদান করে থাকে। সিলেটের অনেক কম্পিউটার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরীতে অর্থ বিনিয়োগ করা উচিৎ। সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বল্পকালীন কম্পিউটার কোর্স চালু করতে পারে। সিলেট অঞ্চলে কম্পিউটার বিক্রয় এবং সার্ভিসিং এর জন্য নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এ অঞ্চলে কম্পিউটার বিক্রয় এবং সার্ভিসিং এর জন্য শিক্ষিত জনবল দরকার। দোকানের মালিক এবং কর্মচারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগের একটি খাত হতে পারে আই.টি সেক্টর।

৭.বেত শিল্প (Cane Industry):
সিলেট অঞ্চলে বেত শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে সিলেট শহরের ঘাসিটুলা এলাকায় বেত-এর মাধ্যমে পণ্য তৈরি হয়ে থাকে। বেতের তৈরী পণ্যগুলোর মাঝে সোফাসেট, বিভিন্ন মাপের খাট, ডাইনিং সেট, ড্রেসিং টেবিল, চেয়ার, টুল, মোড়া, রকিং চেয়ার, ইজি চেয়ার ইত্যাদি প্রধান। উৎপাদিত বেত পণ্য নবাবরোড, জিন্দাবাজার, দরগাহ গেইট প্রভৃতি এলাকায় শোরুমের মাধ্যমে বিক্রয় হয়ে থাকে। বেঁতের পণ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন। সিলেট অঞ্চলে বেঁত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ.বি কেইন এন্ড রাতান ফার্নিচার, মডার্ণ কেইন ফার্নিচার, উজ্জ্বল কেইন ফার্নিচার, সিলেট কেইন ফার্নিচার, শাহজালাল কেইন ফার্নিচার অন্যতম।
সিলেট শহরের ঘাসিটুলা এলাকায় সুরমা নদীর পাড়ে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার এবং সোমবার বেঁত এর বাজার বসে। সিলেট অঞ্চলের গোয়াইনঘাট, হরিপুর, আলুরতল, চিকনাগুল, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ছাতক প্রভৃতি জায়গায় বেঁত উৎপন্ন হয়। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ছাড়াও চট্টগ্রামসহ পাহাড়ী এলাকায় বেঁত পাওয়া যায়। এছাড়াও বেঁত ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানী করা হয়। সিলেটের খাদিমনগরের বিসিক শিল্প নগরীতে প্রতিষ্ঠিত মানাও রাতান ফার্নিচার লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ.বি কেইন এন্ড রাতান ফার্নিচার এ ইন্দোনেশিয়ার মানাও রাতান বেত এর ফার্নিচার পাওয়া যায়। সিলেট শহরের ছোট ছোট ফ্যাক্টরী ও কিছু কিছু বাড়ীতে বেঁত এর পণ্য তৈরি হয়। দেশী ও বিদেশী কাঁচামালের উচ্চমূল্য, শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধি, মূলধনের অভাব, উচ্চ ব্যাংকে সুদ, বনবিভাগের বেতগাছ সংক্রান্ত সমস্যা প্রভৃতিকে বর্তমানে সিলেট অঞ্চলের বেঁত শিল্পের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। প্রবাসী বিনিয়োগের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের বেঁত শিল্পকে আরও উন্নত করা সম্ভব। যথাযথ মার্কেটিং স্ট্রেটেজি এবং উন্নত শোরুমের মাধ্যমে বেঁত পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
 
৮.স্বাস্থ্য সেবা খাত (Health Sector):
সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণের মানসম্মত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। সিলেট জেলায় মান সম্মত ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে তবে এখনও পর্যন্ত ব্রেইন সার্জারী ও হার্টের বাই-পাস সার্জারী শুরু হয়নি। সিলেট জেলাতে একটি সরকারী ও চারটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ রয়েছে। হবিগঞ্জে নতুন একটি সরকারী মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে। হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় মানসম্মত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অভাব রয়েছে। সিলেট শহরের প্রায় ৩০/৩৫ টি ক্লিনিক রয়েছে। এছাড়াও বিয়ানীবাজারে ২/৩ টি এবং জুড়িতে ক্লিনিক রয়েছে। সুনামগঞ্জে ক্লিনিকের সংখ্যা ৭/৮টি, হবিগঞ্জে প্রায় ১০টি এবং মৌলভীবাজারে ১২/১৩টি ক্লিনিক রয়েছে। সিলেট উইমেন্স কলেজ, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ, নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজ, আল্-হারামাইন হাসপাতালে প্রবাসী বিনিয়োগ রয়েছে।
সিলেট অঞ্চলে বড় আকারের হাসপাতাল এবং বড় আকারের স্পেশিয়ালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও প্রবাসী বিনিয়োগের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ অঞ্চলে উন্নতমানের বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব। সিলেট অঞ্চলের মেডিকেলগুলোতে এখনও দক্ষ জনবলের অভাব বয়েছে। সিলেট অঞ্চলের সব উপজেলায় স্থায়ীভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, এম্বুলেন্স এবং চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত সব ধরণের উন্নত চিকিৎসা সেবার উপকরণ এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রয়োজন।
 
৯.শিক্ষা খাত (Education Sector):
সিলেট অঞ্চলের শিক্ষা খাতে প্রবাসী বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বিগত ৮/১০ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে সিলেট অঞ্চল উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিদেশ থাকার প্রবণতা অনকেটা হ্রাস পেয়েছে। সিলেট শহরের রাইজ, ইউরোকিডস, সানিহিল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবাসী বিনিয়োগ রয়েছে।
সিলেট অঞ্চলে প্রথাগত শিক্ষার প্রতিই বেসরকারী উদ্যোগ বেশি প্রতীয়মান হয়। সিলেট অঞ্চলে বর্তমান সময়ে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সিলেট ছাড়াও সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে প্রবাসী বিনিয়োগের মাধ্যমে ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যেতে পারে। সিলেট শহরে বর্তমানে চারটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগের মাধ্যমে কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। প্রবাসী বিনিয়োগের মাধ্যমে গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ প্রভৃতি উপজেলাগুলোতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ভালে মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে। মৌলভীবাজার শহরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। সিলেট অঞ্চলে নার্সিং কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
 
১০.কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী শিল্প (Agricultural Machinaries Industry):
সিলেট অঞ্চলে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলিম ইন্ডাষ্ট্রিজ এবং আবুল ইন্ডাষ্ট্রিজ অন্যতম। আলিম ইন্ডাষ্ট্রিতে কর্মরত কর্মচারী এবং কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ৩৫০ জন। আবুল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ জন। উৎপাদিত যন্ত্রগুলো পাওয়ার ট্রিলার, ধান-গম মাড়াই কল, রিপার, ড্রাইয়ার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, আলু উত্তোলন যন্ত্র, সার প্রয়োগ যন্ত্র ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত যন্ত্র বিক্রয় হয়ে থাকে। আলিম ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে প্রায় এক কোটি টাকার বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানী করে থাকে। কৃষি যন্ত্রাংশের উপর ট্যাক্সের পরিমাণ কমালে এবং সাবসিডি প্রদান করলে এই সেক্টর আরও উন্নতি লাভ করবে। সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগের আরও একটি খাত হতে পারে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী শিল্প।
উচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাত হিসেবে স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী শিল্পসমূহকে প্রনোদনা হিসাবে কৃষি ঋণের হারে ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিসিকের প্লট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ফি ও সার্ভিস চার্জ হ্রাস করলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরীর সম্ভাবনা দেখা যাবে।
 
১১.ব্যাটারী ও টায়ার উৎপাদন খাত (Battery and Tyre Production Sector):
সিলেট অঞ্চলে ব্যাটারী ও টায়ার উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেটে উৎপাদিত ন্যাচারাল রাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে গাড়ী, মটর সাইকেল, বাই সাইকেল ও রিকশার টায়ার উৎপাদন করা সম্ভব। সিলেটে ব্যবহৃত পুরাতন ব্যাটারীগুলো রিসাইক্লিং করে সিলেটেই উৎপাদন করে সমগ্র দেশে বিক্রয় করা সম্ভব।
সিলেটের খাদিমনগরে অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরীতে সানটেক এনার্জি লিমিট এবং সানটেক টায়ার লিমিটেড ব্যাটারী এবং টায়ার উৎপাদন করে থাকে। এ শিল্প বিকাশে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানো যেতে পারে।

১২.ইট উৎপাদন (Brick Production):
সিলেট অঞ্চলে ইটের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নতুন ইটের ভাটা নির্মাণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি থেকে ১২ কোটি ইট উৎপন্ন হয় যা সিলেট অঞ্চলের প্রয়োজন পুরোপুরি মেঠাতে সক্ষম হচ্ছে না। সিলেট জেলায় প্রায় ৭৫ থেকে ৮০টি ইটের ভাটা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে এবং রাস্তাঘাট সহ বাড়ীঘর নির্শাণে প্রচুর ইটের প্রয়োজন। এখনও সিলেট অঞ্চলের ৭৫% বাড়ীঘর মাটির তৈরী। এগুলোর উন্নয়নের জন্য ইটের প্রয়োজন। সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশী হবার কারণে ইট উৎপাদন কম হয়। সিলেট অঞ্চলে ইট উৎপাদনে শ্রমিক স্বল্পতা বিদ্যমান রয়েছে। ইট উৎপাদন ব্যবসাকে এখনও শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
নদীবাহিত পলি মাটি ব্যবহার করে ইট উৎপাদন করা যায়। সরকারী উদ্যোগে পলি ব্যবহারের সুযোগ দান করলে ইটভাটার মালিকগণ উপকৃত হবেন। ইট ভাটার মালিকগণ সরকারী অফিসগুলোর বন্ধুসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করেন। সার প্রয়োগের কারণে কৃষি জমির উপরিভাগের ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। কৃষি জমির উপরিভাগে ইট উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব হলে ইট ব্যবসায়ীগণ উপকৃত হবেন। ইট ভাটার মালিকগণ নিয়মিত ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান করলেও ব্যবসায়িগণ তুলনামূলক কম মূল্যায়ন পেয়ে থাকেন। ইট উৎপাদনে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হলেও এই সেক্টরকে অবহেলার চোখে দেখা হয় বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন। পরিবেশ আইন পরিবর্তনের ফলে ব্যবসায়ীগণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
সিলেটের ইট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তেতলি এলাকার আজমল ব্রিক সাপ্লাইয়ার, খাদিমনগর এলাকার ডি.এইচ.বি ব্রিক সাপ্লাইয়ার, দক্ষিণ সুরমার রশীদপুরের সেভেন স্টার ব্রিক সাপ্লাইয়ার, গোয়াইনঘাটের এম.এইচ.বি ব্রিক সাপ্লাইয়ার ইত্যাদি অন্যতম। সিলেট অঞ্চলের গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের আরও ইটের ভাটা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এছাড়া হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জে প্রচুর ইটের ভাটা রয়েছে।

১৩.প্লাস্টিক শিল্প (Plastic Industry):
সিলেট অঞ্চলে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরীর ফ্যাক্টরী স্থাপন করা সম্ভব। প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল যেমন- বিভিন্ন ধরনের দানা, বিভিন্ন রং, বিভিন্ন ধরনের ফয়েল এবং পিপি বিভিন্ন দেশ থেকে (প্রধানত সৌদিআরব থেকে) আমদানী করা হয়ে থাকে। বিসিক শিল্প নগরী এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোন তৈরী হলে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরীর ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সিলেট অঞ্চলে প্লাস্টিক সামগ্রী যেমন- প্লাস্টিক বক্স, প্লাস্টিক ইনজেকশন, ওয়ান টাইম গøাস, টুথপিক, স্যান্ডেল, খেলনা, স্টেশনারী, ব্যাগ, প্লাস্টিক হ্যাঙ্গার, বোতল, ফাইল ইত্যাদি উৎপাদন করা যেতে পারে। সিলেট অঞ্চলে প্লাস্টিকজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্বালানীর অভাব, দক্ষ কর্মীর অভাব, ক্ষুদ্র আঞ্চলিক বাজার, বিনিয়োগের অভাব, সিন্ডিকেট ব্যবসা ইত্যাদিকে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। উপযুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে প্লাস্টিকজাত পণ্যের বিকাশ ঘটানো সম্ভব।

১৪.খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প (Food Processing Industry):
সিলেট অঞ্চলে ফুড প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রির সম্ভাবনা রয়েছে। বিসিক শিল্পনগীর গোটাটিকরে মেসার্স মেঘনা অটো রাইস মিল, মেঘনা কর্ণফুলী রাইস মিল রয়েছে। তাছাড়াও বিভিন্ন ধরনে বিস্কুট ফ্যাক্টরী সিলেটে রয়েছে। এ শিল্পে সিলেট অঞ্চলে এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের বিনিয়োগ হচ্ছে না। হবিগঞ্জের মনতলায় কোয়ালিটি ইনটিগ্রেইট এ্যাগ্রো লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চিকেন প্রসেসিং প্যান্ট ইতিমধ্যেই উৎপাদন শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ভেজিটেবল প্রসেসিং প্ল্যান্ট এবং ফিস প্রসেসিং প্ল্যান্ট কয়েক মাসের মধ্যেই উৎপাদন শুরু করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

১৫.ক্যাবল ইন্ডাষ্ট্রি (Cable Industry):
সিলেট অঞ্চলে ক্যাবল উৎপাদন বা বিক্রয় সম্ভব। বর্তমানে আবাসন শিল্পে এবং কলকারখানায় প্রচুর তারের ব্যবহার হচ্ছে। ক্যাবলের চাহিদা প্রচুর এবং উৎপাদন করা সম্ভব হলে এর বাজার রয়েছে। রাবার, কপার এলুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ইত্যাদি ক্যাবল উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাঁচামাল দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এবং বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়ে থাকে। সিলেটে ক্যাবল উৎপাদন করা সম্ভব হলে বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব। ক্যাবলের মার্কেট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবহন সমস্যা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, মজুরীর পরিমাণ বৃদ্ধি, চট্টগ্রামের সাথে দূরত্ব ইত্যাদিকে এ অঞ্চলের ক্যাবল শিল্পের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

১৬.মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প (Fish Processing Industry):
সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হতে পারে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ঘোপালে এবং বলাউড়ায়, সিলেট শহরের খাদিম নগরে এবং সুনামগঞ্জে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরী রয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকৃত মাছ বিদেশে রপ্তানী করা হয়। মাছের উৎস হতে কাছাকাছি স্থানে  এবং যোগাযোগের সুবিধাজনক স্থানে যেমন সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের উভয়পার্শ্বে এবং ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায় মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওড় এলাকা হতে মাছ সংগ্রহ করা যায়। দেশের মানুষের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই Ready to cook  (রান্নার জন্য প্রস্তুতকৃত) পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাই স্থানীয় বাজারে প্রক্রিয়াজাতকৃত মাছের যথেষ্ঠ চাহিদা রয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রবাসীগণের দেশী পণ্যের প্রতি আকর্ষণ থাকার ফলে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশের প্রক্রিয়াজাতকৃত মাছের চাহিদা রয়েছে। মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্র সিলেট বিভাগের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মৎস্য আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাছের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিরাপদ করতে পারলে মাছের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। এছাড়াও সিলেটের বিস্তীর্ণ অনাবাদী এলাকায় মাছ চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরী স্থাপন করা যায়। সিলেট অঞ্চলে এ শিল্প বিকাশে কিছু সমস্যা রয়েছে। মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মেশিনারীজের খুচরা যন্ত্রাংশের অপ্রতুলতা রয়েছে। যন্ত্রপাতির জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর নির্ভর করতে হয়।
এছাড়াও এ শিল্প বিকাশে টেকনিক্যাল জনবলের অভাব রয়েছে। যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
 
১৭.জৈবসার কারখানা (Bio Fertilizer Plant):
সিলেট অঞ্চলে বায়ো ফার্টিলাইজার প্ল্যান্ট-এর সম্ভাবনা রয়েছে। জৈব সারের কাঁচামাল সংগ্রহ করার ফলে পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে। সিলেট শহরে অথবাবিভিন্ন পৌরসভাতে, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে বায়ো ফার্টিলাইজার প্ল্যান্ট করা সম্ভব। জৈব সারের কাঁচামাল পৌরসভা অথবা সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং এলাকা এবং বিভিন্ন সবজি বাজারের ওয়েস্টেজ সবজি থেকে সংগ্রহ করা যায়। গরুর গোবর, ড্রেনের বর্জ্য, কচুরী পানা ইত্যাদি থেকে জৈব সার প্রস্তুত করা সম্ভব।
বহুল প্রচারের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর মাধ্যমে প্রত্যেক উপজেলার কৃষকের দ্বারপ্রান্তে জৈব সার পৌছে দিয়ে এবং ব্যবহার পদ্ধতি মিলিয়ে এ সার বিক্রয় করা সম্ভব।
বায়ো প্ল্যান্ট থেকে যে গ্যাস উৎপন্ন হবে, তাও ব্যবহার করা সম্ভব। বিদ্যুৎ সমস্যা, ব্যাংক ঋণ সমস্যা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদিকে সিলেট অঞ্চলে জৈব সার উৎপাদনের সমস্যা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এছাড়াও সিলেট অঞ্চলের কৃষক বা জনগণ বায়ো-ফার্টিলাইজার ব্যবহার বা এর গুণগত মান সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত তেমনভাবে অবগত নয়।

১৮.গবাদিপশুজাত শিল্প (Livestock Industry):
সিলেট অঞ্চলে গবাদিপশুজাত শিল্পের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে হলিষ্টিন ফ্রিজিয়ান, জার্সি ক্রস জাতের গাভী সম্বলিত দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামার রয়েছে। সিলেট জেলায় ছোট বড় প্রায় ৮০টি দুগ্ধ খামার রয়েছে। এদের মাঝে সিলেট শহরের শিবগঞ্জে অবস্থিত প্রভাতি দুগ্ধ খামার, আখালিয়ায় অবস্থিত তাসকিয়া ডেইরী ফার্ম, মেজরটিলায় অবস্থিত ইউনাইটেড ফার্ম অন্যতম। এছাড়াও আলমপুর ও আলুরতলে দুগ্ধ উৎপাদনকারী ফার্ম রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত খামার এবং উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাপক ঘাস চাষের জমি সমন্বিত দুগ্ধ খামার স্থাপন প্রয়োজন।
সিলেট জেলার গ্রামাঞ্চলে প্রায় সব উপজেলাতেই মুরগীর খামার রয়েছে। হাঁসের খামার সুনামগঞ্জে, বিশ্বনাথ, জগন্নাথপুর, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে রয়েছে। সিলেটে ছাগলের খামার সীমিত। প্রধানত গৃহস্থালীর মহিলারাই ছাগল লালন-পালন করেন। এ অঞ্চলে ছাগলের খামারের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেটে অঞ্চলের তরল দুধের চাহিদা মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ ডেইরী মিটিয়ে থাকে। এ অঞ্চলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা প্রয়োজন। সিলেট অঞ্চলে প্রান্তিক খামারীদের দুগ্ধ বাজারজাতকরণ সমস্যা রয়েছে। এ অঞ্চলে ঘি-মাখন-পনির ইত্যাদি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। প্রচুর চাহিদা এবং সিলেট অঞ্চলের নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা শক্তিশালী থাকায় দুগ্ধ, ঘি, পনির, মাখন উৎপাদনে বৃহৎ বিনিয়োগ হতে পারে। সিলেট অঞ্চলে দুগ্ধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঘাস চাষের জমি প্রাপ্তি একটি সমস্যা। ঘাস উৎপাদনে এখনো পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি অর্জন করা যায়নি। দানাদার খাদ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন। প্রবাসী বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে গবাদিপশুজাত শিল্প।

১৯.চারকোল উৎপাদন (Charcoal Industry):
সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা থাকায় চারকোল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। অটোরাইস মিলের তুষ সিলেট বিভাগের সকল জেলা এবং উপজেলা থেকে ক্রয় করে আনা প্রয়োজন এবং যে সকল স্থানে রাইস মিল আছে সেখানে চারকোল উৎপাদন করা যেতে পারে।

২০.ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (Small and Cottage Industry) :
সিলেট অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেটে এ খাতে অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন। সিলেটের মণিপুরী তাঁত শিল্প পণ্যের যথেষ্ঠ চাহিদা দেশে ও বিদেশে রয়েছে। সিলেট শহরের লামাবাজার এলাকায় মণিপুরী তাঁত পণ্যের অনেকগুলো বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এ শিল্প বিকাশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ শিল্পের পাষ্টার ভিত্তিক আরও উন্নত নকশার সরবরাহ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হলে এ শিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। সিলেটে বিসিক শিল্পনগরীসমূহে প্লট বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে বিধায় সিলেট অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা তথা উন্নত প্লট, রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানি প্রভৃতির সুযোগ সম্বলিত বেসরকারী খাতে শিল্প এলাকা স্থাপন করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের শিল্পায়ন তরান্বিত হবে এবং উদ্যোক্তাগণও লাভবান হবেন।। সিলেটে একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হলে এখাতে আরও দক্ষ উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে  এবং এ অঞ্চলে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।

এছাড়াও সিলেট অঞ্চলে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি’র সম্ভাবনা রয়েছে।

সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগের অন্যান্য খাতসমূহ:
এছাড়াও শিল্পখাতে সিলেটকে এগিয়ে নিতে নিম্নোক্ত খাতগুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে:
*    গ্লাস উৎপাদন
*    সিমেন্ট উৎপাদন
*    চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প
*    টেক্সটাইল শিল্প
*    বিদ্যুৎ প্লান্ট

সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা সমূহ:
আতলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে উদ্যোক্তাগণ নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ব্যাংক ঋণ জটিলতার কারণে অনেকে উৎসাহ হারাচ্ছেন। উচ্চ ব্যাংক সুদ সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের অন্তরায়। সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত স্পেশাল ইকোনোমিক জোন চালু হয়নি। বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির অপর্যাপ্ততার কারণেও শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও এ বিভাগের সব অঞ্চলে ভালো নয়। সহায়ক প্রতিষ্ঠা সমূহের (যেমন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কার্যকর ভূমিকা প্রবাসী বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে একান্ত প্রয়োজন।

ঢাকা-সিলেট এবং সিলেট-চট্টগ্রামের দূরত্ব অনুযায়ী সড়ক এবং রেল ভ্রমণে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। এতে আরোহীগণের মাঝে ভ্রমণজনিত ক্লান্তি দেখা যায়। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নিরাপদ এবং আরামদায়রক ভ্রমণ প্রয়োজন। নিম্নে সিলেট শহরের সাথে বিভিন্ন জেলার দূরত্ব তুলে ধরা হলো।
সিলেট-ঢাকা    দূরত্ব - ২৩৯ কিলোমিটার
সিলেট-চট্টগ্রাম    দূরত্ব - ৩৫৯ কিলোমিটার
সিলেট-বরিশাল    দূরত্ব - ৩৭২ কিলোমিটার
সিলেট-রাজশাহী     দূরত্ব - ৪৫২ কিলোমিটার
সিলেট-রংপুর    দূরত্ব - ৫০৭ কিলোমিটার

আকাশপথে সিলেট-ঢাকার দূরত্ব ১৯৯ কিলোমিটার এবং রেলপথে সিলেট-ঢাকার দূরত্ব ২৪২.২ কিলোমিটার। সিলেট থেকে ঢাকা যেতে প্রায় ৬ ঘন্টা সময় লাগে। রেলপথে ঢাকা যেতে ৭-৮ ঘন্টা সময় প্রয়োজন  হয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে দীর্ঘ সময় ভ্রমণ একটি অন্তরায়। ঢাকা- সিলেট নৌ-পথে তেমনভাবে পণ্য পরিবহন হচ্ছে না। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিক্ষাবৃত্তি একটি সমস্যা।

সিলেট বিভাগে প্রবাসী বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের জন্য বাধাস্বরূপ কিছু মৌলিক সমস্যা রয়েছে। এগুলোকে আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ক্ষদ্র আঞ্চলিক বাজার, কাঁচামাল আনয়নে অধিক পরিবহন ব্যয়, বিপুল পরিমান নীচু এলাকায় দূরূহ যাতায়াত ব্যবস্থা, অদক্ষ জনশক্তি, অনুন্নত পার্শ্ববর্তী দেশের অঞ্চল  প্রভৃতিকে আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ অঞ্চলের যুবকদের মাঝে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাগ্রহণের চেয়ে বিদেশ যাবার প্রবনতা দেখা যায় বেশী। বিনিয়োগ সম্পর্কিত জ্ঞান, ঝুঁকির পরিমান নির্ণয় এবং আত্মবিশ্বাস বিকাশে শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাপক। পারিবারিক সদস্যদের বদৌলতে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ পাওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে তরুণ ও যুবকদের মাঝে জ্ঞান অর্জনে অনীহা দেখা যায়। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট প্রচুর অর্থ থাকা সত্তে¡ও ব্যবসা সংক্রান্ত ধারণার অভাবে নতুন উদ্যোগতা তুলনামূলভাবে কম তৈরী হচ্ছে।

ঝুঁকিগ্রহনে অনীহা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার অভাবে নতুন নতুন ব্যবসা উদ্ভাবন করা সম্ভব  হচ্ছে না। যুব সমাজের একটা অংশ তাদের আত্মীয়স্বজনদের কর্তৃক প্রেরিত অর্থ দ্বারা নিজের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন এবং এর ফলে নির্ভরশীল থাকার মানসিকতা তৈরী হচ্ছে। প্রবাসী বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের অন্তরায় হিসেবে অন্যান্য কারণ সমূহ হলো:
*    জমি সংক্রান্ত সমস্যা (মূল্য, বিরোধ মিমাংসা ও রক্ষণাবেক্ষণ)
*    প্রারম্ভিক মূলধনের অভাব
*    প্রযুক্তি ব্যবহারে যোগ্যতাগত সীমাবদ্ধতা
*    অনুন্নত সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ
*    আবহাওয়া জনিত সমস্যা, ইত্যাদি।  

সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণের উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাম্ভাব্য পদক্ষেপ সমূহ:
সিলেট অঞ্চলের উদ্যোগক্তাগণ সিলেট অঞ্চলে প্রবাসীগণের অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে সাম্ভাব্য বিনিয়োগের খাত চিহ্নিত করে বিনিয়োগ ও উৎপাদন করলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। উপযুক্ত উৎপাদনমুখী খাত সনাক্তকরণ, সাম্ভাব্য উদ্যোগতাগণের মাধ্যমে ব্যবসায়ীক উদ্যোগ গ্রহণ এবং সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সিলেট চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম। সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল মহল থেকে বিনিয়োগকারীগণ এবং সাম্ভাব্য বিনিয়োগকারীগণকে উৎসাহ এবং সুবিধা প্রদান প্রয়োজন। নতুন নতুন ব্যবসা সংক্রান্ত প্রজেক্ট পরিকল্পনা করা এবং সাম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সাথে এর পরিচয় ঘটানো দরকার। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীগণ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা লাভে সক্ষম হবেন। সিলেট চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, মতবিনিময় সভা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং উন্নয়মূলক দিক নির্দেশনা লাভ করা সম্ভব। ব্যবসায়ীক কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দূরত্ব অনুযায়ী সড়কপথে ভ্রমণের সময় কমিয়ে ৩/৪ ঘন্টা এবং রেলপথে ৪/৫ ঘন্টায় আনা সম্ভব হলে প্রবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ  করা প্রয়োজন। ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট এবং চট্টগ্রাম-ঢাকায় নৌপথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে সড়ক পথের উপর চাপ কমবে এবং যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে। এতে সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।

নতুন ব্যবসা আরম্ভের পদ্ধতিগত আনুকূল্য: নতুন ব্যবসা কার্যক্রম আরম্ভের জন্য প্রচলিত বিধি মোতাবেক বিভিন্ন পূর্ব শর্তের সংখ্যা ও ধাপ সমূহ, সম্পূর্ণ পদ্ধতি সম্পন্ন করনের জন্য সময়ের ব্যাপ্তি, খরচ এবং নূন্যতম মূলধনের  প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় নিয়ে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি আবশ্যক।

ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মান কার্যের সরকারী অনুমোদন প্রক্রিয়া: ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো স্থাপন/নির্মানের ক্ষেত্রে সরকারের সহায়ক ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সরকারী অনুমোদন প্রক্রিয়াকরনের ধাপ, সময়কাল, আনুষঙ্গিক খরচ এবং স্থাপনের মান নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থার উপর সার্বিক মান নির্ভর করে।

রেজিষ্ট্রেশন পদ্ধতি: রেজিষ্ট্রেশনের দীর্ঘ সূত্রিতা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় অনেক সময় উদ্যোক্তাদের নতুন ব্যবসা স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সহজ, দ্রæত এবং স্বল্প-ব্যয়ের রেজিষ্ট্রেশন পদ্ধতি নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

ক্রেডিট সহায়তা: ব্যাংক এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্রেডিট সহায়তা প্রদান এবং আইনী সুরক্ষার নিশ্চয়তা। কম সুদে এবং ক্ষেত্র বিশেষে জামানতবিহীন ব্যবসায়ীক ঋণ প্রদান।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায়িক সুরক্ষা: ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার  জন্য পরিচালনা পর্যদের দায়বদ্ধতা, শেয়ার হোল্ডারদের অধিকার সুরক্ষা, কর্পোরেট স্বচ্ছতা এবং মালিকানার নিয়ন্ত্রনের ব্যাপ্তি।

ট্যাক্স বিধিমালা: ট্যাক্স সংক্রান্ত বিধিমালা এবং কর্পোরেট ট্যাক্স এর ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক/সরকারী নমনীয়তা।
আমদানী/রফতানীর সুযোগ: আমদানী কিংবা রফতানী মূখী বানিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা, খরচ, সময় এবং পৃষ্ঠপোষকতা।

দেউলিয়াত্ব নিরসন ব্যবস্থা: দেউলিয়াত্ব নিরসনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও ব্যবসায়িক সুরক্ষা।

এছাড়াও নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলি বিবেচনায় আনা জরুরী :
* বিশ্বস্থ দেশীয় উদ্যোক্তাগণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করে সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণকে মালিকানা স্বত্ব (Equity)  হিসেবে বিনিয়োগে আগ্রহী করে মূলধন সংগ্রহ করার মাধ্যমে প্রবাসীগণের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বজায় রাখা।
* আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণের লক্ষে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা।
* সরকারী জমি লীজ নেবার ক্ষেত্রে শিল্পে বিনিয়োগকারীগণকে অগ্রাধিকার প্রদান।
* ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দের দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত সহায়তা এবং আন্তরিকতা বৃদ্ধি।
* ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে রেল, সড়ক ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
* সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত সেবাসমূহকে আরও আধুনিক, সময়োপযোগী এবং অধিক সেবাধর্মী করা।
* বিসিক শিল্প নগরীতে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ।
* শিল্পে অপেক্ষাকৃত উন্নত বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন ইত্যাদি।

লেখক :: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৩ ডিসেম্বর ২০১৮/প্রেবি/আআ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন